ঊষার আলো রিপোর্ট : দেশে বর্তমানে ধূমপায়ীর সংখ্যা প্রায় ১ কোটি ৯২ লাখ। আর জর্দা-সাদাপাতার মতো তামাক গ্রহণ করেন ২ কোটি ২০ লাখ মানুষ। ধোঁয়াবিহীন এসব তামাকগ্রহণকারীদের অধিকাংশই নারী। এটি দেশের তামাকবিরোধী সংগঠন প্রজ্ঞার হিসাব।
বিশেষজ্ঞ ও তামাকবিরোধী সংগঠনের সদস্যদের মতে, বিড়ি-সিগারেটের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে প্রায় সবাই অবগত। আছে এ ব্যাপারে সচেতন করার প্রয়াসও। তবে এর ফাঁক দিয়ে আড়াল হয়ে পড়ছে ধোঁয়াবিহীন তামাক। আর এই উদাসীনতার বলি হয়ে প্রতি বছর ভয়ংকর পরিণতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে লাখো অন্তঃসত্ত্বা নারী ও শিশু।
চুরুট, গুল, জর্দ্দা, সাদাপাতা, খৈনির মতো তামাকজাত দ্রব্যগুলোকে বলা হচ্ছে ধোঁয়াবিহীন তামাক। বাংলাদেশ তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনে একইসঙ্গে ধোঁয়াযুক্ত ও ধোঁয়াবিহীন তামাক নিয়ন্ত্রণের কথা বলা হলেও বাস্তবিক ক্ষেত্রে ধোঁয়াবিহীন তামাকের ক্ষতিকর দিক নিয়ে আলোচনা হয় খুবই কম।
ধোঁয়াবিহীন তামাক নিয়ে শঙ্কার কথা জানালেন বারডেম হাসপাতালের অধ্যাপক ডা. অরূপ রতন চৌধুরী। তিনি বলেন, বাংলাদেশে ধোঁয়াবিহীন তামাক যেমন; জর্দ্দা, গুল, সাদাপাতার ব্যবহার অনেক পুরোনো এবং বিশাল সংখ্যক মানুষ এর ব্যবহারকারী। বিশেষ করে নারীরা এগুলো বেশি খেয়ে থাকেন। ধোঁয়াবিহীন তামাক গ্রহণের ফলে মানুষের মুখে এক ধরনের ঘা তৈরি হয়, যা পরবর্তীতে ক্যানসারে রূপ নিতে পারে। এ ছাড়া এসব তামাক সরাসরি রক্তেও প্রবেশ করে। ফলে মহিলাদের হার্ট অ্যাটাক, ফুসফুসে সংক্রমণের মতো দুর্ঘটনাও ঘটতে পারে।
ডা. অরূপ রতন চৌধুরী বলেন, অন্তঃসত্ত্বা নারীদের ক্ষেত্রে ধোঁয়াবিহীন তামাকের প্রভাব আরও ভয়ংকর। অন্তঃসত্ত্বা নারীরা এই তামাক গ্রহণের কারণে গর্ভপাত, নবজাতকের কম ওজন, অপরিণত শিশুর জন্ম-এমনকি বিকলাঙ্গ শিশুরও জন্ম হতে পারে। এ ছাড়া অন্তঃসত্ত্বা নারীর মৃত্যুসহ মৃত নবজাতকের জন্মের কারণও এই ধোঁয়াবিহীন তামাক।
গ্লোবাল অ্যাডাল্ট টোব্যাকো সার্ভে বাংলাদেশ (গ্যাটস) এর পরিসংখ্যানমতে (২০১৭), দেশে ধোঁয়াবিহীন তামাক সেবনকারীদের মধ্যে ১৬ দশমিক ২ ভাগ পুরুষ এবং ২৪ দশমিক ৮ ভাগ নারী। এ ছাড়া ২০১৪ সালে স্বাস্থ্যবিষয়ক সাময়িকী দ্য ল্যানসেটের একটি গবেষণায় আসে, বাংলাদেশের শতকরা ২০ ভাগ প্রজননক্ষম নারী ধোঁয়াবিহীন তামাক গ্রহণ করেন।
আরও ভয়ংকর তথ্য ওঠে আসে ২০১০-১১ সালে পরিচালিত ঢাকা মেডিকেল কলেজের এক গবেষণা থেকে। বাংলাদেশ চাইল্ড হেলথ সাময়িকীর ২০১৬ সালে প্রকাশিত ওই গবেষণায় জানা যায়, দেশে জন্মানো অপরিণত নবজাতকদের মায়েদের শতকরা ৪৬ ভাগই গুল সেবন করেন। আর এর মধ্যে জর্দ্দা খান শতকরা ২১ দশমিক ৭৩ ভাগ নারী। অর্থাৎ অপরিণত শিশুর জন্মের পেছনে একটি অন্যতম কারণ হিসেবে কাজ করে ধোঁয়াবিহীন তামাক।
দেশের তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনে পরিস্কারভাবে বলা আছে, যেকোনো তামাকজাত দ্রব্যের মোড়কের ৫০ ভাগ জায়গা জুড়ে এর ক্ষতিকর দিকগুলো সম্পর্কে লেখা থাকবে। থাকবে সচিত্র সতর্কবার্তাও। কড়া বিধিনিষেধের ফলে বিড়ি-সিগারেটের ক্ষেত্রে এই আইনটি এখন মানা হচ্ছে। কিন্তু এই বিধি-নিষেধের বাইরে রয়ে গেছে ধোঁয়াবিহীন তামাক।
দিনাজপুরে অবস্থিত হাজী মোহাম্মাদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক আশরাফী বিন্তে আকরাম বলেন, ধোঁয়াবিহীন তামাকে সচিত্র সতর্কবার্তা ও মাতৃস্বাস্থ্য নিয়ে আমি ও আমার দু’জন শিক্ষার্থী কিছুদিন আগে গবেষণা শুরু করি। আমরা দেখলাম, এ দেশে এ বিষয়টি নিয়ে তেমন উল্লেখযোগ্য কাজ হয়নি। তাই আমাদের অনেকাংশে আন্তর্জাতিক গবেষণার ওপর নির্ভর করতে হয়। অথচ দেশের নারী ও শিশুদের ওপর এর প্রভাব মারাত্মক। আমরা আমাদের গবেষণায় সময়, শ্রম ও সাধ্যের ভেতরে তিনটি জেলা থেকে ধোঁয়াবিহীন তামাক পণ্যের কিছু নমুনা সংগ্রহ করে দেখলাম, এসব পণ্যের অধিকাংশের মোড়কে দেশের প্রচলিত তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনটির যথাযথ প্রয়োগ নেই। যেখানে পণ্যের গায়ে ৫০ ভাগ জায়গাজুড়ে সতর্কবার্তা থাকার কথা, সেখানে কোনোমতে “গলায় ও মুখে ক্যান্সার হয়“ এই কথাটি লেখা আছে শুধু। গর্ভস্থ সন্তানের যে ক্ষতি হয়, তার তেমন উল্লেখই নেই। অথচ শিক্ষিত- অশিক্ষিত সকল ধোঁয়াবিহীন তামাক সেবনকারীদের জন্য সচিত্রবার্তা চমৎকারভাবে কাজ করতে পারে। এ বিষয়ে মনিটরিংটা জরুরি।
চিকিৎসকদের মতে, দেশের ধোঁয়াবিহীন তামাক ব্যবহারকারীদের মধ্যে অধিকাংশই নারী। আর এ কারণেই বর্তমানে সবচাইতে ঝুঁকিতে রয়েছেন দেশের অন্তঃসত্ত্বা নারী ও নবজাতকেরা।
(ঊষার আলো-এমএনএস)