UsharAlo logo
বুধবার, ৮ই মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ২৫শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

সামাজিক স্তরবিন্যাসঃ শ্রেণী বনাম বর্ণ

koushikkln
জুন ৫, ২০২১ ৯:৪০ অপরাহ্ণ
Link Copied!

সামাজিক স্তরবিন্যাস একটি সামাজিক সমস্যা। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ষের পাঠ্য সূচিতে এই বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত থাকায় বিষয়টির ওপরে কিছুটা পড়াশোনা করার সুযোগ হয়েছিলো। কিন্তু ছাত্রজীবনের সেই পর্যায়ে বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করে উঠতে পারিনি। বাস্তব জীবনে এসে তার কদর্য রূপ দেখতে পেয়েছি। তাই এই বিষয়ে কিছু লেখার জন্য কলম ধরা। সভ্যতার শুরু থেকে আজ পর্যন্ত সমাজে স্তরবিন্যাস বিরাজমান। সেই স্তর বিন্যাসের স্বরূপ বহুবিধ। মানুষে মানুষে, গোষ্ঠীতে গোষ্ঠীতে শক্তি, সামর্থ্য, জ্ঞান, রুচি, চাহিদা প্রভৃতি বিষয়ে অসমতা থাকে। সেই অসমতাজনিত কারণে সমাজে শ্রেণী বিভাজন তৈরী হয়।

আমি প্রথমে শ্রেণী বিভাজনের উৎপত্তি এবং ইতিহাস নিয়ে আলোচনা করছি। এখানে বলে রাখা দরকার যে শ্রেণী এবং বর্ণ এক বিষয় নয়। আপাতঃ দৃষ্টিতে এক মনে হলেও এদের মধ্যে যোজন যোজন পার্থক্য। আমি প্রথমে শ্রেণী কী, তার উৎপত্তি এবং বিবর্তন নিয়ে আলোচনা করব। তারপর যাব বর্ণ বিষয়ে আলোচনায়। পৃথিবীর সব দেশে শ্রেণী আছে, মতাদর্শগত বিভাজন আছে। কিন্তু সেখানে ভারতীয় মডেলের জন্মগত বর্ণপ্রথা নেই। ভারতবর্ষে শ্রেণীও আছে আবার জন্মগত বর্ণপ্রথাও আছে। সভ্যতার শুরুতে সমাজে যৌথ পরিবার ছিলো। মিশরে ও মেসোপটেমিয়ায় সবার আগে সেই যৌথ পরিবারে অসমতা দেখা দেয়। ধনী দরিদ্রের ব্যবধান বৃদ্ধি পায় হয়; দ্রুত শ্রেণী ব্যবস্থা গড়ে উঠে। শোষণ প্রথার উৎপত্তি হয়। সভ্যতার একটা বড় বিশেষত্ব এই শ্রেণীশাসন। মিশর ও মেসোপটেমিয়ায় এই শ্রেণী শাসন ভিত্তিক রাষ্ট্র কাঠামো তৈরী হয় এবং তা ধীরে ধীরে অনেক জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে। আমাদের ছাত্রজীবনে নবম ও দশম শ্রেণীর ইংরেজি পাঠ্য বইয়ে প্রথম যে প্রবন্ধটি ছিলো তার নাম ছিলো – “Wise men of the old”। তার প্রথম লাইনের কিছুটা এখানে তুলে ধরছি। When the people of Britain were uncivilized, barbarians, dwelling in caves a wonderful civilazation was flourishing in Greece. গ্রীস দেশের গুরুত্ব বোঝানোর জন্য উপরের লাইনটি উদ্ধৃত করলাম। অথচ এই গ্রীস দেশেই প্রথম ঘৃণ্য দাসপ্রথার জন্ম হয়। গ্রীকদের আগে আর কোনো সমাজে দাসত্বের বুনিয়াদ তৈরী হয়নি। গ্রীকদের আদি বাসস্থান গ্রীসে ছিলো না। খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০ সালে গ্রীকরা গ্রীসের আদিবাসীদের নির্মূল করে এবং সেখানে বসতি স্থাপন করে। তখন তারা যে সব ভূমি দখল করতো এবং যে সব দ্রব্য লুট করতো তা সমানভাবে বন্টন করা হতো না। বন্টন ব্যবস্থায় অসমতা ছিলো। ছোট বড় ভেদে তা ভাগ করা হতো। শাসক ও সেনাপতি সবচেয়ে বেশি পেতো। তারাই ছিলো অভিজাত। এই অভিজাতরাই শ্রেণী শোষণকারী। বিভাজিত সমাজের নমুনা এগুলো।

খ্রিস্টপূর্ব সপ্তম শতকের শেষের দিকে ল্যাটিন জাতিগুলির মধ্যে শ্রেণী সমাজ গড়ে উঠে। সেখানে অভিজাতদের বলা হতো পেট্রিসিয়ান। তারা ছিলো মূলতঃ দাস ব্যবসায়ী ও সুদের কারবারি। কৃষকেরা ঋণ শোধ করতে ব্যর্থ হলে তাদের দাস বানাত। ফরাসী বিপ্লবের পূর্বে ফ্রান্সের জনগণ তিন ভাগে বিভক্ত ছিলো। প্রতিটি শ্রেণীকে এস্টেট বলা হতো। ধর্মযাজক ও অভিজাতরা ছিলো যথাক্রমে প্রথম এস্টেট ও দ্বিতীয় এস্টেট। তাদের কোনোরূপ কর প্রদান করতে হতো না। কর দিতে হতো সাধারণ জনগণকে যাদের বলা হতো তৃতীয় এস্টেট। কৃষক ও সাধারণ জনগণ তাদের সামান্য আয় থেকে রাষ্ট্রকে দিতো কর, ধর্মযাজককে টাইথ আর ভূস্বামী অভিজাতকে খাজনা। এই হলো শ্রেণী শোষণের নমুনা। এরপর সেদেশে আরেকটা শ্রেণীর জন্ম হয় যাদের বলা হয় বুর্জোয়া। বুর্জোয়া কারা? লেখক, চিকিৎসক, শিক্ষক, আইনজীবী, বিচারক, সরকারী কর্মচারী প্রভৃতি শিক্ষিত শ্রেণী; বণিক, শিল্পপতি, ব্যাংকার প্রভৃতি টাকাওয়ালা – এদেরকে বুর্জোয়া বলে অভিহিত করা হয়েছিলো। অভিজাতদের সাথে তাদের বনিবনা হচ্ছিল না। অভিজাত ব্যক্তির গৃহে কোনো বুর্জোয়ার নিমন্ত্রণ হলে খেতে দেয়া হতো ভৃত্যদের সাথে। এই বু্র্জোয়ারাই ফরাসী বিপ্লবের সূচনা করে এবং নিজেদের শ্রেণীস্বার্থ পুরোপুরি আদায় করে। তারপর পূঁজিবাদী সমাজে ধন বৈষম্যের কারণে শোষণের রূপরেখা দেখেছি। মূলধনের নগ্ন চরিত্র দেখেছি। সস্তায় শ্রমিকের শ্রম শক্তি বেচাকেনা হয়েছে। সামন্তযুগে ভূমিদাসকে শোষণ করা হতো, দাসপ্রথায় দাসকে শোষণ করা হতো আর পূঁজিবাদে শ্রমিক শোষণ করা হয়। অর্থশাস্ত্রে Division of labour. আছে। পৃথিবীর সকল সমাজে আমরা শ্রেণী বিভাজন দেখতে পাই, সাথে সাথে শ্রেণী শোষণ। এই সকল বিভাজন, শ্রেণী, শাসন, শোষণ এর মূলে আসল অমৃতময় বস্তুটি কী। মার্কসের দর্শন সম্পর্কে এঙ্গেলস বলেছেন: “সারা বিশ্ব-প্রাকৃতিক, ঐতিহাসিক এবং মানস: একটা ক্রম ছাড়া আর কিছুই নয়। ইহা গতিশীল, বিকাশের পথে নিয়ত পরিবর্তিত হইতেছে। অর্থনীতি, রাষ্ট্রনীতি, আইন, ধর্ম ও শিক্ষা পরষ্পরের সাথে একই সূত্রে গ্রথিত; প্রত্যেকটি পরষ্পরের সাথে নির্ভরশীল। কিন্তু এসবের ভিত্তিমূল হলো অর্থনীতি।” অর্থাৎ সমুদ্র মন্থন থেকে উত্থিত বিষয়টি আর কিছু নয়, সে হলো অর্থ।

মীর মোশারফ হোসেন বলেছিলেন – স্ত্রীর ন্যায় ভালোবাসে জগতে আর কে আছে? সেই ভালোবাসাও টাকা না থাকলে প্রত্যাশা করা নিরর্থক। জগতে টাকাই সব, টংকাহি কেবলম্। সমাজতন্ত্রে ব্যক্তির সুখ স্বাচ্ছন্দ্য, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও উন্নতির পূর্ণ সুযোগ থাকে। উৎপাদনের উপকরণগুলির উপর ব্যক্তির স্বত্ব থাকে না, থাকে সমষ্টির। ফলে সকলের বিকাশ সম্ভব বলে দাবী করা হয়। কিন্তু মানুষ তা নিলো কই? মানুষের স্বাতন্ত্র্যবোধ সমষ্টিগত সমাজের পক্ষে যায় না। সেই স্বতন্ত্র্য সত্তা শ্রেণী বিভাজনের মূল চালিকাশক্তি। মানুষ জন্মমাত্র সর্বভুক। তাই সমাজে শ্রেণী বিভাজন তৈরী হয়। এ বিষয়ে পরবর্তী পর্বে শ্রেণী ও বর্ণের সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করা হবে।

লেখক: প্রশান্ত কুমার রায়, সদস্য, ট্যাক্সেস এপিলেট ট্রাইব্যুনাল, বেঞ্চ-৪, ঢাকা।