UsharAlo logo
বৃহস্পতিবার, ২৫শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ১২ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

বাল্যবিবাহ ; একটি অভিশাপ ও স্বপ্নভঙ্গের উত্থান

usharalodesk
জুন ১৩, ২০২১ ৮:৩৪ অপরাহ্ণ
Link Copied!

সেলিনা আক্তার : মানুষের জীবন-মৃত্যুও মাঝে বিবাহ প্রকৃতির একটি অলঙ্ঘনীয় বিধান। সামাজিক ও ধর্মীয় বৈধ চুক্তির মাধ্যমে দু’জন প্রাপ্ত বয়স্ক নারী-পুরুষের মধ্যে এই বিবাহ বন্ধন তৈরি হয়। জৈবিক চাহিদা পূরণ ও ভবিষ্যতের বংশ বিস্তার বিবাহের অন্যতম উদ্দেশ্য। এজন্য মানব জীবনে বিবাহ অতি প্রয়োজনীয়। কিন্তু অতি অল্প বয়সে বিবাহ পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের উপর মারাত্মক ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। এছাড়া অল্প বয়সে বিবাহ দেয়া শিশু নির্যাতন বা যৌন নির্যাতনের মধ্যেও পড়ে যা আমাদের দেশের অনেকে তা বিশ্বাস করেন না।
বাল্যবিবাহ নামটার সঙ্গে কৈশোর-কৈশোর একটা ভাব রয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশের অন্যতম সমস্যাগুলোর মধ্যে বাল্যবিবাহ একটি। একসময় বাল্যবিবাহ বাংলাদেশের মহামারি আকার ধারণ করেছিল। এখনো যে বাল্যবিবাহ হয় না তা নয়। প্রত্যন্ত অঞ্চলের মেয়েদের জন্য এই শব্দটা বিভীষিকাময় এক অধ্যায়। আমার গ্রামের এক কিশোরী, নাম আছমা। তার বয়স ১৪ বছর সে পড়াশুনা করত। তার বাবা ভ্যানচালক আর মা মানুষের বাসায় কাজ করে। ছয় ভাই-বোন তার। মেয়েটি পড়াশুনাই ভালো ছিল। কিন্তু সে বেশি দিন পড়তে পারল না। মা-বাবা তার চেয়ে দ্বিগুণ বয়সের এক ছেলের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দেয়। কিছুদিন যেতেই আছমার ঘরে জন্ম নেয় এক অপরিপক্ক সন্তান। আছমা ও সন্তান দুজনই পুষ্টিহীনতায় ভুগছে। যে বয়সে আছমার স্কুলের বারান্দা আর ক্লাস রুমে থাকার কথা ছিল সে বয়সে সে তার সন্তানের দায়িত্ব পালন করছে।
বাংলাদেশে ১ থেকে ১৮ বছর পর্যন্ত হলো শিশুকাল। তাই ১৮ বছর বয়সের আগে বিয়ে হলে তাকে শিশু বিবাহ বা বাল্যবিবাহ বলে। বাংলাদেশের বিয়ের আইন অনুযায়ী পুরুষদের জন্য ২১ বছর এবং নারীদের জন্য ১৮ বছর নির্ধারণ করা হয়েছে। অর্থাৎ উভয়ের মধ্যে যেকোনো একজনের ১৮ বছরের নিচে বিবাহ হলে তা বাল্যবিবাহ হবে। আমাদের দেশে মেয়ে শিশুদের একটি বড়ো অংশের বিয়ে হয় ১৮ বছরের নিচে। বাল্যবিয়ে বন্ধে ইতোমধ্যে সরকার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করছে। গবেষণায় দেখা যায় অজ্ঞতা ও কুসংস্কারের কারণে এখন ও বাল্যবিয়ে হচ্ছে।
নানা সূচকে বিশে^র রোল মডেল বাংলাদেশ। মাতৃমৃত্যুও হার কমে আসাও এই অর্জনের অন্যতম। দিনে দিনে বাল্যবিবাহ কমে আসায় কমছিলো মাতৃমৃত্যুর হার। কিন্তু করোনা মহামারির মধ্যে বেড়েছে বাল্যবিবাহ। দেশে আগের তুলনায় এই সময়ে বাল্যবিবাহ বৃদ্ধি পেয়েছে ১৩ শতাংশ।
করোনাকালে অভিভাবকের কাজ না থাকা, সন্তানের স্কুল খোলার নিশ্চয়তা না থাকা এবং অনিরাপত্তা বোধ থেকে দেশে বেড়ে গেছে বাল্যবিবাহ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দারিদ্র্য, অশিক্ষা, সামাজিক নিরাপত্তার অভাবসহ নানা কারণে বাল্যবিবাহ বন্ধ করা যাচ্ছে না। এতে মাতৃমৃত্যুর হার বৃদ্ধিরও আশঙ্কা করছেন তারা। তাছাড়া সচেতনতা ও আইন দিয়েই মূলত বাল্যবিবাহ রোধ প্রচেষ্টা চলছিল। কিন্তু করোনাকালে বেড়ে গেছে বাল্যবিবাহ। মূলত: গ্রামঞ্চলে চুপিসারে দেওয়া হচ্ছে এসব বিবাহ। সামাজিক নিরাপত্তার অভাব ও দারিদ্র্যই এ সময়টিতে বাল্যবিবাহ বেড়ে যাওয়ার কারণ বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
বাল্যবিবাহ নারীর অগ্রগতির ব্যাহত করে। এর ফলে নারীর অগ্রযাত্রাও বাধাগ্রস্ত হয়। অল্প বয়সে বিবাহ মাতৃমৃত্যুর ঝুঁকি বাড়ায়। এমনকি নবজাতকের মৃত্যুর আশঙ্কা তৈরি করে। অনেক সময় নবজাতক মারাও যায়। নবজাতক বেঁচে থাকলেও পরবর্তীতে শারীরিক ও মানসিক জটিলতায় ভোগে। অপ্রাপ্ত বয়স্ক মায়ের প্রতিবন্ধী শিশু জন্মদানের সম্ভাবনা বেশি থাকে। অল্প বয়সে বিবাহের ফলে একটি মেয়ের পক্ষে অন্য একটি পরিবারের অনেক বিষয় সামাল দেওয়া বেশ কঠিন হয়ে পড়ে। এর ফলে অনেক শারীরিক ও মানসিক যন্ত্রণার শিকার হয়। অনেক সময় বিবাহ বিচ্ছেদের মত ঘটনাও ঘটে। পরবর্তীতে ঐ মেয়ের বাবা-মায়ের উপর বাড়তি চাপ তৈরি হয়, যা কোন বাবা-মা কখনো কামনা করেন না। মেয়ের ভবিষ্যতটাও অনিশ্চিত হয়ে পড়ে।
বাল্যবিবাহ কখনো ভালো ফল আনতে পারে না। তাই সর্বদা নেতিবাচক ফলবাহী বাল্যবিবাহ বন্ধে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন পদক্ষেপ ও আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। তবুও আমাদের দেশে বাল্যবিবাহ থেমে নেই। এটা বন্ধ করতে না পারলে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গী নষ্ট হবে ও দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি এবং টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন ব্যাহত হবে।
(ঊষার আলো-এমএনএস)