UsharAlo logo
মঙ্গলবার, ৭ই মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ২৪শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

নিয়মের বালাই নেই খালিশপুর লাল হাসপাতালে: সেবা বঞ্চিত রোগীরা

koushikkln
সেপ্টেম্বর ২০, ২০২২ ১০:৪০ অপরাহ্ণ
Link Copied!

ঊষার আলো প্রতিবেদক : রবিবার (১৮ সেপ্টেম্বর), সকাল ৮টা। খালিশপুর লাল হাসপাতালের গেটের সামনে দেখা হাসি (৫৪) নামের এক নারী রোগীর সাথে । তিনি জ্বর আর ব্যাথার চিকিৎসার জন্য এসেছেন।  এসেছেন ১২নং ওয়ার্ডের হাউজিং বাজার এলাকা থেকে। তার স্বামীর নাম মোস্তফা। হাসপাতালের গেট খোলা পেলেও চিকিৎসককে পাননি। ছিল না কোন স্টাফ। সকাল ৮টাই তাদের হাসপাতালে আসার কথা।  শুধু এদিন নয়, বিগত দিনেও তারা সরকারের বেধে দেয়া সময়ে হাসপাতালে আসার রেকর্ড নেই বলে এলাকাবাসীরা জানান। যদিও বৃদ্ধা হাসি চিকিৎসার জন্য টিকিট বুকিং দেন সকাল ৯টায়। আর চিকিৎসকের সাথে সাক্ষাতের সুযোগ হয় ৯টা ৪০ মিনিটে। এই দীর্ঘ সময় তিনি হাসপাতালেই বসে ছিলেন।

চিকিৎসা (চিকিৎসাপত্র নাম্বার-৯২৭৮/২২) শেষে তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, সকাল ৮টায় এসেছি। চিকিৎসক আর স্টাফরা সঠিক সময় না আসার কারণে বসে থাকতে হলো দীর্ঘ সময়। তারপরও ডাক্তার দেখানোর পর সব ওষুধ লিখে দিয়েছে। বাইরে থেকে কিনে খেতে বলেছে। বাইরে থেকে কিনে খেতে পারলে এই গরীবের হাসপাতালে কি আসতাম। এলার্জি ও গলা ব্যাথা নিয়ে ৮নং ওয়ার্ড থেকে এসেছেন খোকনের স্ত্রী হাতিন(৪০)। চিকিৎসাপত্র নং-২০৪৪/২২। তিনিও সুর মিলিয়ে বলেন, তিন দিনের ওষুধ দিয়েছে। এত দূর থেকে আসলাম কম পক্ষে সাত দিনের ওষুধ দিতে পারতো। ২/১ প্রকার ওষুধ দিলেও বেশী ওষুধ কিনে খেতে বলে চিকিৎসক। সকাল সোয়া ৯টায় হাসপাতালে ঢুকতেই দেখা যায় টিকিট বিক্রেতা খালেদা টিকিট সংগ্রহে ব্যস্ত সময় পার করছেন। এ সময় তার সামনে ২০ জনের মত রোগী বসে আছে। তার মধ্যে তিনজন ছিল পুরুষ। দরিদ্র মানুষের হাসপাতাল হিসেবে পরিচিত লাল হাসপাতালে প্রায় ৯০ ভাগ রোগীই মহিলা। বাকী ১০ ভাগ পুরুষ। এমনই তথ্য দিলো হাসপাতালের স্টাফরা।

হাসপাতাল বোর্ডে ৩২ প্রকার ওষুধের নামের তালিকা ইংরেজিতে লেখা রয়েছে। তার মধ্যে ৯ প্রকার ওষুধ নেই। প্রথম তালিকাভুক্ত ওষুধের নাম হচ্ছে-প্যারাসিটামল-৫০০এমসি এবং শেষ তালিকায় রয়েছে আই অয়েনমেন্ট।

ওষুধের স্টোর রুমে কাজ করতে দেখা যায় লাইলী বেগম নামের একজন স্টাফকে। তিনি পিওন পদে আউট সোর্সিং হিসেবে এখানে আসলেও প্রায় সময় ফার্মাসিস্ট রুমে বসে খোশগল্পে রত থাকেন। অফিসে আসেননি সালাউদ্দীন নামের একজন স্টাফ। তিনি প্রায়ই অফিসে দেরি করে আসেন বলে অভিযোগ রয়েছে। সকাল সাড়ে ১০টায় অফিসে আসেন সুলতান নামের একজন স্টাফ। আবার সকালে হাসপাতালে দেরী করে আসেন অন্য দিকে দুপুর ২টার আগেই হাসপাতাল ত্যাগ করেন অধিকাংশই। এতে করে এলাকাবাসী সুচিকিৎসা থেকে হচ্ছেন বঞ্চিত। তবে শিশুদের কোভিড টিকা দেয়ার কারণে স্টাফরা কেউ কেউ দেরীতেই হাসপাতাল ত্যাগ করছেন এখন।

১০নং ওয়ার্ডের দুর্বার সংঘ ক্লাবের মোড়ের বাসিন্দা রেশমা আক্তার (চিকিৎসাপত্র নং-৬৩৬৪/২২, তাং-৫/৭/২২ইং) জানান, তিনি এলার্জি জনিত সমস্যা নিয়ে লাল হাসপাতালে আসেন। চিকিৎসা পত্রের দাম রাখা হয় ১০টাকা। কিন্তু ডাক্তার দেখার পর মাত্র চারটি গ্যাসের ট্যাবলেট দেন। বাকী ওষুধ কিনে খেতে হয়। শুধু তাকে একা নয় এভাবে অধিকাংশ রোগীকে গ্যাসের ট্যাবলেট আর প্যারাসিটামল দিয়ে বিদায় জানায় চিকিৎসক। বাকী ওষুধ কিনে খেতে বলেন। লাল হাসপাতালে ফ্রি ওষুধ দেয়া হয়, এমনই খবরে হাসপাতালে আসা। কিন্তু ওই খবরের বাস্তবায়ন হচ্ছে না বলে তার অভিযোগ। তিনি বলেন, প্রায় পৌনে ১২ টার দিকে হাসপাতালে আসা হয়। তার পরে যারা চিকিৎসা নিতে এসেছে, সবাইকে টিকিট না দিয়ে বাড়ি ফেরৎ চলে যেতে বলে টিকিট বিক্রেতা মহিলা। চিকিৎসা না নিয়েই ফেরৎ যাওয়া রোগীর সংখ্যা হবে ২/৩ জন। সবুজের স্ত্রী শাহিনুর (৪৫), সুলতানের স্ত্রী হাওয়া বেগমসহ হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের ক্ষোভের শেষ নেই। তারা বলেন, এখানে গরীব মানুষ চিকিৎসা নিতে আসে। কিন্তু নামমাত্র ওষুধ দেয়।

খুলনার নাগরিক ফোরামের যুগ্ম আহবায়ক হাসান হাফিজুর রহমান বলেন, এ অঞ্চলের প্রায় ৫০ হাজার জনগণ এ হাসপাতালে কোন না কোন ভাবে চিকিৎসা সেবা নিয়ে থাকেন। সে জন্যই এ হাসপাতালের স্বাস্থ্য সেবার মান বাড়াতে হবে। সেবামূলক প্রতিষ্ঠানে সরকারি বিধিবিধান মানার জন্য তদারকি বাড়ানোর কোন বিকল্প নেই। বিগত দিনে এ হাসপাতালের ওষুধ চুরির করার সময় স্টাফদের হাতেনাতে ধরা হয়। আবারো একই্ কায়দায় ওষুধ চুরি শুরু হয়েছে বলে এই নাগরিক নেতার আশংকা। এ জন্য তিনি বিষয়টি যথাযথ কর্তৃপক্ষে দৃষ্টি আকর্ষণ করছেন। যাতে করে এলাকাবাসী কোনভাবেই স্বাস্থ্যসেবা ধেকে বঞ্চিত না হয়।
কেসিসির অবসরপ্রাপ্ত সাবেক প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডাঃ আব্দুল্লাহ বলেন, তার সময় দুপুর ২টা পর্যন্ত হাসপাতালে চিকিৎসা সেবা চলতো।

খালিশপুরের ঐতিহ্যবাহি লাল (ম্যাটারনিটি) হাসপাতালের মেডিকেল অফিসার ডাঃ তামজিদা রহমান বলেন, সকাল সাড়ে ৯টায় চিকিৎসা শুরু হয়। বেলা সাড়ে ১২টা নাগাদ টিকিট বিক্রি শেষ হয়। তবে অফিস সময় ৩টা পর্যন্ত। যারা টিকিট সংগ্রহ করতে পারেন তাদের দেখা হয়। ১৭ সেপ্টেম্বর ৪১জন রোগী চিকিৎসা গ্রহণ করেছেন। গড়ে প্রতিদিন ১০০ রোগী চিকিৎসা নিয়ে থাকেন। রোগী প্রয়োজন অনুসারে ওষুধ দেয়া হয় বলে জানান।

খুলনার নাগরিক ফোরামের সদস্য সচিব এড. সেলিনা আক্তার পিয়া বলেন, বিষয়টি উদ্বেগের। হাসপাতালের চিকিৎসক আর স্টাফরা নির্ধারিত সময় আসবেন না। আর রোগীরা সকালে এসে ঘন্টার পর ঘন্টা অপেক্ষায় থাকবেন। এটা হতে পারে না। এ জন্য তদারকি বাড়াতে হবে। দায়িত্বশীলদের দিয়ে মনিটরিং করতে হবে। আর সরকার যে ওষুধ দিচ্ছে তা রোগীরা পর্যাপ্ত পাবে না। এটা কি করে সম্ভব। গরীব মানুষের জন্যই তো সরকার ওষুধ দিচ্ছে হাসপাতালে। আর তা না দিয়ে স্টাফরা বাইরে নিয়ে বিক্রি করবে। এটা মেনে নেয়া যায় না। বিষয়টি মেয়র ও সিভিল সার্জনের নিকট উপস্থাপন করা হবে বলে তিনি জানান।

কেসিসির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা.স্বপন কুমার হালদার জানান, লাল হাসপাতালে প্রধানত সাধারণ রোগের চিকিৎসা দেয়া হয়। এখানে কেসিসি ও সিভিল সার্জন অফিস যৌথভাবে সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করে। এখানে চিকিৎসকের পদ ২টি থাকলেও চিকিৎসক আছেন একজন। সহকারি চিকিৎসক আছেন ২জন। ফার্মাসিস্ট আছেন ১জন, এফডাবিøউভি আছেন দু’জন, জোনাল ইনচার্জ তিনজন, মাঠ কর্মী আছেন ১৪ জন। এখানে চাহিদা অনুযায়ী প্রতি মাসে ১৫/১৬ প্রকার ওষুধ কেসিসির পক্ষ থেকে দেয়া হয় আর সিভিল সার্জনের পক্ষ থেকে ১০/১২ প্রকার ওষুধ দেয়া হয়। এ হাসপাতালে প্রতিদিন গড়ে ১০০ জন রোগী চিকিৎসা নেন। ওষুধের চাহিদা পত্র দু’সপ্তাহ আগে দেয়া হয়। সে অনুযায়ী ওষুধ সরবরাহ করা হয়। সপ্তাহে একদিন তিনি হাসপাতাল পরিদর্শনে যান। তখন কোন ত্রæটি চোখে পড়লে তাৎক্ষণিক সমাধানের চেষ্টা করেন। মূলত আগত রোগীদের প্রাথমিক চিকিৎসা নিশ্চিত করতে তারা কাজ করছেন বলে এই স্বাস্থ্য কর্মকর্তা জানান।

খুলনার সিভিল সার্জন ডাঃ সুজাত আহমেদ বলেন, সরকার নির্দেশীত সময়ে অফিসে আসতে হবে এবং সঠিক সময়ে অফিস ত্য্গা করতে হবে। এ আদেশ না মানার কোন কারণ থাকতে পারে না। লাল হাসপাতালে কর্মরত তার স্টাফরা এ আদেশ না মানলে প্রমাণ সাপেক্ষে বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। রোগীদের মাঝে বিনামূল্যে বিতরণের জন্য ২৭ প্রকার ওষুধ সিভিল সার্জন অফিস থেকে লাল হাসপাতালে দেয়া হয়। সরকারি ওষুধ রোগীদের মাঝে চাহিদা অনুযায়ী দিতে কোন সমস্যা আছে বলে তিনি মনে করেন না। যারা এ ওষুধ দিতে চায় না তাদের রক্ষা নেই। সরকার গরীব মানুষদের দেয়ার জন্য ওষুধ দিয়েছে আর সে ওষুধ বিক্রি করে খাবে তা হতে পারে না। এসব বিষয় তিনি নিজে খোঁজ খবর নিতে শিগগিরই হাসপাতালে যাবেন বলে জানান।