UsharAlo logo
রবিবার, ২৮শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ১৫ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
আজকের সর্বশেষ সবখবর

বেহাল ‘টুটপাড়া তালতলা হাসপাতাল’

koushikkln
সেপ্টেম্বর ২৬, ২০২২ ৯:২৪ অপরাহ্ণ
Link Copied!

ঊষার আলো প্রতিবেদক : অর্ধশত বছরের বেশি সময় ধরে খুলনা মহানগরীর একটি বড় অংশের মানুষদের সেবা দিয়ে চলেছে টুটপাড়া তালতলা হাসপাতাল। শয্যাহীন এই হাসপাতাল থেকে গড়ে প্রতিদিন ৬০-৬৫ জন রোগী সেবা নিচ্ছেন। সকাল ৮টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত রোগীরা সেবা নিচ্ছেন এখান থেকে। কিন্তু বয়সের ভার আর যেন সহ্য করতে পারছে না দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে স্থাপিত এই হাসপাতালটি! ‘ছাদের পলেস্তারা খসে পড়ে আহত হতে পারেন’ এমন আশঙ্কার মধ্যেও বাধ্য হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসছেন রোগীরা। গত এক বছর ধরে হাসপাতালে নেই কোন এমবিবিএস চিকিৎসক। দু’জন প্যারামেটিক দিয়েই চলছে এই প্রাথমিক চিকিৎসা সেবা। হাসপাতালে কেসিসি থেকে দেয়া হয় না কোন ওষুধ। যা ওষুধ দেয়া হয় তা সিভিল সার্জন অফিস থেকে। তবে বেশীর ভাগ রোগীদের চিকিৎসা শেষে বিনামূল্যে ওষুধ দেয়া হচ্ছে প্যারাসিটামল আর ভিটামিন-বি। অথচ সিভিল সার্জন থেকে ২৭ প্রকারের ওষুধ দেয়া হয়। প্রতি বছর পাঁচ লাখ টাকার ওষুধ সরবরাহ করা হয় এই হাসপাতালে।

জীবনের ঝুঁকি নিয়েই দু’জন চিকিৎসকসহ ১৪ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী রোগীদের চিকিৎসা দিচ্ছেন। খুলনা সিটি করপোরেশন পরিচালিত এই হাসপাতালটি কবে নাগাদ সংস্কার করা হবে তা বলতে পারছেন না সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, খুলনা মহানগরীর সর্ববৃহৎ এলাকা হিসেবে পরিচিত টুটপাড়া। এই এলাকার মানুষের চিকিৎসেবা প্রদানের জন্য স্থাপন করা হয় ‘টুটপাড়া তালতলা হাসপাতাল’। হাসপাতাল চত্বরে একটি তালগাছের কারণে এর নামকরণ হয়ে যায় ‘টুটপাড়া তালতলা হাসপাতাল’। সময়ের ব্যবধানে তালগাছটি না থাকলেও রয়েছে হাসপাতালটি। বাউন্ডারী ওয়াল না থাকার কারণে হাসপাতালটি অরক্ষিত হয়ে পড়েছে। এ সুযোগে চত্বরটি ইট পাথর আর বালু ব্যবসায়ীদের দখলে চলে গেছে। তারা এ চত্বরে প্রতিনিয়ত ইট, পাথর, আর বালু রেখে হাসপাতালের পরিবেশ নস্ট করছে বলে হাসপাতালের স্টাফদের অভিযোগ।

শনিবার বেলা সাড়ে ১১টা। তালতলা হাসপাতালটি নিরব। নেই তেমন কোন রোগীর কোলাহল। হাসপাতালের বোর্ডে ১৭ প্রকার ওষুধের তালিকা রয়েছে। তবে কোনটি শেষ হয়েছে আর কোন আছে তা বুঝবার কোন সংকেত ছিল না বোর্ডে। ওষুধ কোম্পানীর দু’জন প্রতিনিধি মোবাইলে ব্যস্ত ছিলেন। রওশনারা (৬৪) নামের একজন বৃদ্ধা ওষুধ নিয়ে হাসপাতাল থেকে বের হন। তার চিকিৎসাপত্র নাম্বার ৬৬৯/৫৬। তিনি বায়তুল আমানমহল্লার বাসিন্দা আঃ খালেকের স্ত্রী। তিনি চর্মরোগ আর ব্যাথা নিয়ে হাসপাতালে নিয়মিতই আসছেন। তিনি বলেণ, হাসপাতালে আসলে ২/১ প্রকার ওষুধ দেন। বাকী ওষুধ কিনে খেতে বলেন। টাকা নেই কিনে খাব কি করে। তাকে ভিটামিন ও চর্মরোগের মলম দেয়া হয়েচে। আরে কান ওষুধ দেয়া হয়নি। তবে চিকিৎসাপত্রে আরো চার প্রকার ওষুধ লেখা রয়েছে, যা বাইওে থেকে কিনে খেতে হবে। ওই একই রোগী একই রোগ নিয়ে আসেন গত ২৪ আগস্ট। তখন তাকে শুধু প্যারাসিটামল দেয়া হয়। বাকী পাঁচ প্রকার ওষুধ কিনে খেতে বলা হয় বলে এই দরিদ্র বৃদ্ধা জানান। হাসপাতালের কর্ণারের রুমে একা বসে টিকিট বিক্রি করছেন কেসিসির স্বাস্থ্যকর্মী মাকসুদা। এ হাসপাতালে তিনিসহ চারজন স্বাস্থ্যকর্মী আছে কেসিসির, তবে ওই দিন বাকী তিনজন নগরস্বাস্থ্য কেন্দ্রে ট্রেনিং-এ গেছেন বলে তিনি একাই সব সামলাচ্ছেন বলে জানান।

তিনি জানান, ওই দিন ৬০ জন চিকিৎসাপত্র নিয়েছেন। টিকিট মূল্য নতুন হলে ১০টাকা আর পুরানো হলে পাঁচ টাকা রাখা হয়। তবে যার টাকা নিয়ে সমস্যা থাকে তাকে বিনামূল্যেই চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয় বলে তিনি জানান। ১৮/১৯ বছর ধওে তিনি এখানে চাকুরি করেন। গত বৃহস্পতিবার ৫৯ জন চিকিৎসাপত্র নিয়েছে। গড়ে এখােন প্রতিদিন ৬০-৬৫ জন রোগী চিকিৎসা সেবা গ্রহণ কওে থাকেন। গত এক বছর হয়ে গেছে এখানে এমবিবিএস চিকিৎসক নেই। দু’জন প্যারামেটিক দিয়ে চিকিৎসা সেবা চলছে। আর হাসপাতালের পরিবেশ খুবই নাজুক। যে কোন সময় ভেঙ্গে রোগী ও স্বাস্থ্য কর্মীদের ক্ষয়-ক্ষতি হতে পারে। সম্প্রতি বৃষ্টিতে হাসপাতাল পুরো তলিয়ে যায়। ফ্যান খুলে মাথার ওপর পড়ে মৃত্যুও ঝুকি আছে বলে তিনি আশংকা করছেন।

তিনি আরো বলেন, সকাল ৮টায় চিকিৎসা শুরু হয় আর বেলা সাড়ে ১২টা পর্যন্ত টিকিট বিক্রি করা হয়। সব কিছু গোছাতে গোছাতে দুপুর আড়াইটা থেকে তিনটা পর্যন্ত অফিস খোলা থাকে বলে তিনি দাবী করেন। বটিয়াঘাটার পুটিমারী থেকে আসছেন মাহমুদা(২৯)। তার স্বামীর নাম-সুফিয়ান। তাকে ফ্রি দেয়া হয়েছে প্যারাসিটামল, ওমিপ্রাজল ট্যাবলেট, ভিটামিনসহ চার প্রকার ওষুধ। বাকী তিন প্রকার ওষুধ কিনে খেতে বলেছেন। ওই একই রোগী গত ৩১ আগস্ট চিকিৎসার জন্য আসেন। তখন চিকিৎসক তাকে এক প্রকার ওষুধ প্যারাসিটামল ফ্রি দেন। বাকী পাঁচ প্রকার ওষুধ কিনে খেতে বলেন। অফিসের পিওন বেলাল তাকে পাওয়া যায়নি। তবে তিনি বাইরে গেছেন বলে ফামাসিস্ট রেখা রাণী কীর্ত্তণীয়া জানান। তিনি ২০১০ সাল থেকে এখানে কর্মরত আছেন। তার এখানে ১৭ প্রকার ওষুধ আছে। যা শুধু সিভিল সার্জন অফিস থেকে দেয়া হয়। বছরে সিভিল সার্জন অফিস থেকে পাঁচ লাখ টাকার ওষুধ রোগীর জন্য এ হাসপাতালে দেয়া হয়। কেসিসি থেকে গত এক বছর যাবৎ কোন ওষুধ দেয়া হয় না। তিনি বলেন সকাল ৮টায় অফিস শুরু হয় আর শেষ হয় দুপুর আড়াইটায়। তবে হাসপাতালে বসে চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করা তাদেও জীবনের জন্য বড়ই ঝুকিপূর্ন। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ভবনটি বসবাসের অনেকটাই অযোগ্য হয়ে পড়েছে। কখন ছাদের প্লাস্টার খুলে পড়ে, আবার কখন ফ্যান খুলে পড়ে। বৃষ্টি হলেই পানি হাসপাতালের ভিতওে প্রবেশ করে। সব মিলিয়ে এখানে চিকিৎসা সেবা আতংকের মধ্যই নিশ্চিত করা হয় বলে তিনি দাবি করেন।

হাসপাতালে কর্মরত প্যারামেটিক বা উপ-সহকারি কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার মোসাম্মদ শিউলী আক্তার বলেন, সব সময় সব ওষুধ হাসপাতালে থাকে না। দামী দামী ওষুধ সরবরাহ কম। ৮০% রোগীকে বেশী ওষুধ দেয়া হয়। বাকী ২০ভাড় রোগী পরিমাণের চেয়ে কম ওষুধ পান। কারণ শেষের দিকে ওষুধও শেষ হয়ে যায়। এ জন্য ইচ্ছা থাকা সত্বেও ওষুধ দেয়া যায় না।

বর্তমানে হাপাতালটি থেকে প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবা প্রদান করা হচ্ছে। তাছাড়া স¤প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচির (ইপিআই) কার্যক্রমও চলে এই হাসপাতালের মাধ্যমে। কিছু ওষুধ সিটি করপোরেশনের মাধ্যমে দেয়া হলেও প্রয়োজনীয় সব ওষুধই আসে সরকারিভাবে। ১৭ ধরনের ওষুধ এখান থেকে দেয়া হয় রোগীদেরকে বিনামূল্যে।
একসময় দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর খুলনা সিটি করপোরেশন হাসপাতালটির দায়িত্ব নেয় চালু করার। এখনও হাসপাতালটি চালু রয়েছে। তবে দীর্ঘসময় ধরে সংস্কার না হওয়ায় হাসপাতালের দেয়াল এবং ছাদের পলেস্তারা খসে পড়ছে প্রতিনিয়ত।
হাসপাতালের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা জানান, হাসপাতালের ছাদের অবস্থা খুবই খারাপ। ছাদের পলেস্তারা খসে খসে পড়ছে। কখন কার মাথার ওপর ছাদ ভেঙে পড়ে এই আশঙ্কায় তাদের রোগীদের সেবা দিতে হয়। পলেস্তারা খসে পড়ে আহতও হয়েছেন বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা ও কর্মচারী। বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েও কোনো সমাধান মেলেনি। তবে সম্প্রতি তাদেরকে স্থানান্তর করে তালতলা মাতৃসদনে নেয়া হবে বলে কর্তৃপক্ষ আশ্বস্ত করেছেন বলে তারা জানান।
হাসপাতালে সেবা নিতে আসা নাসিমা বেগম, মিজানুর রশিদ, হায়দার আলী ও আসমা বেগম জানান, এই হাসপাতালের রোগীরা গরিব। পাঁচ টাকার টিকিট কিনে সেবা পাওয়া যায় বলে এখানে এলাকার গরিব রোগীরা আসেন। নাম মাত্র ওষুধ দেয়। যা রোগীর চাহিদার চেয়ে অনেক কম। কিন্তু হাসপাতালের বর্তমান পরিস্থিতি এতটাই খারাপ যে, এখানে সেবা নিতে এসে আহত হওয়ার আশংকা রয়েছে।

খুলনা নাগরিক ফোরামের যুগ্ম আহবায়ক হাসান হাফিজুর রহমান বলেন, গত সভায় মেয়র কেসিসির স্বাস্থ্য বিভাগকে নাগরিকদের স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করতে কড়া হুশিয়ারী দিয়েছেন। কোন রকম স্বাস্থ্য সেবায় ব্যাত্যয় ঘটলে তার জবাবদিহিতা করতে হবে বলে সভায় তিনি সকলের সামনে স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের সর্তক করেন। তারপরও যদি নাগরিকরা স্বাস্থ্য সেবা পেতে না পারে তার জন্য কেসিসির স্বাস্থ্য বিভাগ দায়ী থাকবে। নাগরিকদের স্বাস্থ্য সেবায় মেয়রের অগ্রণী ভূমিকার প্রশংসা করে তিনি বলেন, এই মেয়রের আমলে হাসপাতালে ওষুধ দেয়া হবে না তা বিশ্বাস যোগ্য হতে পারে না। যদি স্বাস্থ্য বিভাগ এ রকম ভূল করে তাদের জবাবদিহিতার আওতায় আনার জন্য তিনি মেয়র হস্তক্ষেপ কামনা করেন। তিনি বলেন, তালতলা হাসপাতালটি নিজেই ঝুকিপূর্ন। এটা জরুরী ভিত্তিতে মেরামত করার জোর দাবি জানান এই নাগরিক নেতা।

হাসপাতালটির বিষয়ে খুলনা সিটি কর্পোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. স্বপন কুমার হালদার বলেন, আমাদের অধীনেই টুটপাড়া তালতলা হাসপাতাল চলছে। ওষুধ চাহিদাপত্র দেয়া হলে দেয়া হয়। তবে এক বছর ধরে ওষুধ দেয়া হয় না-এমন তথ্য সঠিক নয় বলে তিনি দাবি করেন। সংস্কারের বিষয়ে বলেন, ‘এই বিষয়ে আমি স্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরকে জানিয়েছি। তারা বিষয়টি দেখছেন বলে জানান।

এ ব্যাপারে কথা হয় খুলনার সিভিল সার্জন ডাঃ সুজাত আহমেদের সাথে। তিনি জানান, সরকার বলেছেন-সীমিত সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যাবহার নিশ্চিত করতে হবে। এটা প্রত্যেক চিকিৎসক ও কর্মকর্তা-কর্মচারিদের করা উচিত। যেহেতু হাসপাতালটি কেসিসি ও সিভিল সার্জনের তত্ত¡াবধানে চলছে। তাই কেসিসির উচিত হাসপাতালটি সংস্কার করা। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে চিকিৎসা সেবাও ভাল হয় না। এটা কেসিসিকে দেখা উচিত বলে এই স্বাস্থ্য কর্মকর্তা মনে করেন। তিনি বলেন, তালতলা হাসপাতালে পোস্টিং দেয়ার মত এমবিবিএস চিকিৎসক আপাতত তার নজরে নেই। জানতে পারলে চিকিৎসককে ডেপুটেশনে ওই হাসপাতালে বদলী করা হবে বলে তিনি আশ্বাস দেন।