UsharAlo logo
বৃহস্পতিবার, ১৮ই এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ৫ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

পদ্মায় স্পিডবোট দুর্ঘটনা: শিশু মিমের কাঁধে মা-বাবা ও দু’বোনের ভার

koushikkln
মে ৩, ২০২১ ১১:১৫ অপরাহ্ণ
Link Copied!

বিশেষ প্রতিনিধি: মায়ের মৃত্যুর খবর পেয়ে খুলনার তেরখাদায় আসছিলেন পারোখালী গ্রামের মনির হোসেন। সাথে ছিলেন স্ত্রী হেনা বেগম, তিন মেয়ে মিম (৯), সুমি (৫) ও রুমি (৩)। কিন্তু কে জানতো মাকে শেষ দেখা দেখতে গিয়ে তিনি নিজেই হারিয়ে যাবেন। মাত্র ৯ বছরের শিশুকন্যা মিমকে কঠিন দায়িত্বে রেখে তিনি স্ত্রী, অপর দু’কন্যা নিয়ে চির বিদায় নেবেন। মিমকে মৃত মা-বাবা ও বোনদের অশ্রুসিক্ত মৃতদেহ সনাক্ত করতে হবে।
সোমবার (০৩ মে) মাদারীপুরের শিবচর উপজেলায় পদ্মা নদীতে একটি বাল্কহেডের সঙ্গে স্পিডবোটের সংঘর্ষের এমনই এক বাস্তবতার মুখোমুখি করেছে। ওই সংঘর্ষে স্পিডবোটটি ডুবে যায়। এ ঘটনায় ২৬ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। যাদের মধ্যে আছে মিমের বাবা-মা ও দুই বোনের লাশও। এ ঘটনায় তেরখাদা এলাকায় শোকের ছায়া নেমে এসেছে। রাতের তাঁদের মৃতদেহ খুলনায় পৌঁছায়।
তেরখাদার বাসিন্দা ডা. মোঃ আছাবুর রহমান তাঁর ফেসবুক পেইজে লিখেছেন ‘আমার তেরখাদা উপজেলার পারোখলি গ্রামের মনির হোসেন তার মায়ের মৃত্যুর সংবাদ পেয়ে গ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা দেন পরিবারের ৫ সদস্য নিয়ে। মাওয়া ঘাটে স্পিডবোট দুর্ঘটনায় সে সহ ৪ জন ঘটনাস্থলেই মারা যায়, ভাগ্যক্রমে বেচে যায় মিম নামের আট বছর বয়সী মেয়ে। গ্রামে শোকের ছায়া নেমে গেছে। আল্লাহ তাদের জান্নাতবাসী করুণ।
এক স্প্রিটবোটে ত্রিশজন কিভাবে উঠায় তাও আবার লাইফ জ্যাকেট ছাড়া, এগুলা দেখার কি কোন অথরিটি নেই?’
স্থানীয় বাসিন্দা, গণমাধ্যম সূত্রে জানাগেছে, সোমবার (০৩ মে) দুপুরে শিবচরের পাঁচ্চর রয়েল হাসপাতালে ভর্তি শিশু মিমকে জিজ্ঞাসা করলে বাবা মা ও দুই বোনের বর্ণনা দিতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পরে সে। শিবচর ইউএনও অফিসের এক কর্মচারী ও বাংলাবাজার স্পিডবোট ঘাটের নৈশ প্রহরী দেলোয়ার ফকিরের তত্বাবধানে শিশুটি হাসপাতালের একটি কে দুপুরের খাবার খাচ্ছিল তখন।

নিহতের মনির শিকদারের ভাই ও শ্বশুর জানান, ঢাকার মিরপুরের  বসবাস করতেন মনির শিকদার। ওখানকার মসজিদ মার্কেটে তার কাপড়ের ব্যবসা ছিল। তার মা লাইলী বেগম মারা যান রবিবার রাতে। সকালে তেরখাদায় পৌছে মায়ের যানাজা ও দাফনে অংশগ্রহনের কথা ছিল তার।
নিহতের ছোট ভাই মোঃ কামরুজ্জামান জানান, তার বাবা মারা মোঃ আলম শিকদার মারা গেছেন ২০০৪ সালে। মা লাইলী বেগম গত রবিবার রাতে মারা যায়। সোমবার সকালে তার দাফন সম্পন্ন হয়েছে। মায়ের যানাজা ও দাফনে অংশগ্রহন করার কথা ছিল মেঝ ভাই মনির শিকদারের। তার দেরি দেখে দাফন সম্পন্ন করা হয় পরে জানাযায় তিনি নেই পৃথিবীতে।
মোঃ কামরুজ্জামানের ছেলে জানান, নারায়নগঞ্জথেকে দাদীর মৃত্যুর সংবাদ পেয়ে সে যখন আসছিল খুলনায় মাওয়া ঘাটে তার সাথে তার চাচার দেখা হয়। তার পরের স্পিড বোর্ডে নদী পার হচ্ছিল চাচা। নদী পার হওয়া হয়নি তার নদীতেই মৃত্যু হয় তার।
নিহতের শ্বশুর আব্দুর সবুর মিঞা জানান, আমার মেয়ের শ্বাশুরির মৃত্যুর খবর পেয়ে জামাই মেয়ে বাড়ি ফিরছিল। পথেই সব শেষ হয়ে গেল।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জানান, মাদারীপুরের শিবচর উপজেলার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার মাধ্যমে তিনি খবর পান। তারপর স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে নিহতের পরিবারকে খবর জানান তিনি। আর পুলিশ বলছে, লাশ নিহতের স্বজনদের কাছে বুঝিয়ে দেওয়া হবে। নিহত প্রত্যেককে ২০ হাজার করে ৮০ হাজার টাকা দিয়েছে শিবচর জেলা প্রশাসন।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সাদিয়া ইসলাম জানান, আমাকে প্রথমে শিবচর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জানান, মনির শিকদার ও তার পরিবার দুর্ঘটনায় মারা গেছেন। তার থেকে সংবাদ পেয়ে আমি উপজেলার সদর ইউনিয়নের চেয়ারম্যানকে জানায়। তিনি নিহতের স্বজনদের চিহ্নিত করেন।
তেরখাদার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (তদন্ত) মোশাররফ হোসেন জানান, লাশ রাতে এসে পৌছেছে। আমরা লাশ তাদের স্বজদের কাছে হস্তান্তর করছি। শিশুটিকে তার নানা-নানীর জিম্মায় রাখছি।
রাত পৌনে নয়টার দিকে তেরখাদার পাড়খালি গ্রামে নিহদের লাশ নিয়ে পৌছালে হৃদয় বিদারক দৃশ্যের অবতারনা হয়। নিহত মনির শিকদার তার চাই ভাইয়ের মধ্যে সেঝ ছিলেন।
মহামারিতে পৃথিবী স্থবির হয়ে গেলেও জীবন চলমান। চলমান এই জীবন সংগ্রামে হার মেনে মৃত্যুকে বরণকরেছে মনির শিকদার আর মৃত্যুঞ্জয়ী বীর হয়ে বেঁচে রইল শিশু মীম।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, শিশু মিমের বাবা মনির হোসেন, মা হেনা বেগম, ছোট দুই বোন সুমি (৫) ও রুমি (৩) স্পিডবোট দুর্ঘটনায় মারা গেছে। তাদের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। লাশ রাখা হয়েছে স্থানীয় একটি স্কুল মাঠে। খুলনার তেরখাদায় এ পরিবারের বাড়ি। সেখানেই যাচ্ছিলেন তারা।
মিমকে উদ্ধারকারী নৌ পুলিশের কনস্টেবল মেহেদী বলেন, ‘শিশুটিকে নদীতে ব্যাগ ধরে ভাসতে দেখি। হাত ও চোখের কাছে আঘাতের চিহ্ন ছিল সামান্য। দ্রুত তাকে পাঁচ্চর রয়েল হাসপাতালে পাঠানো হয়। শিশুটির পরিবারের সকল সদস্যরাই মারা গেছে।’
শিশু মিম শুধু জানে তার মা, বাবা, বোনেরা কেউ বেঁচে নেই। মাঝে মাঝেই মা মা বলে কেঁদে উঠছে সে।