UsharAlo logo
বৃহস্পতিবার, ১৮ই এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ৫ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ফি বছর বাঁধ বাণিজ্য ! উপকূলের মানুষের ঘাসফড়িংয়ের জীবন

koushikkln
জুন ১৩, ২০২১ ২:৫৫ অপরাহ্ণ
Link Copied!

ফি বছর মে মাস আসলেই কয়েক দফা প্রাকৃতিক দুর্যোগের শিকার হয় বাংলাদেশ। বলা হচ্ছে জলবায়ূ পবির্তনের প্রভাব পড়ছে সারাবিশে^। তারই ধারাবাহিকতায় প্রাকৃতিক দুর্যোগ হুমকি হয়ে দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে সমুদ্র উপকূলীয় এলাকায় এ পরিবর্তনের প্রভাব বেশী। তীব্র খরা, লবণাক্ততা, জলাবদ্ধতা, নদী ভাঙন, ঘুর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস ও সুপেয় পানি সংকট বেড়ে চলছে। অবকাঠামোগত উন্নয়ন না থাকলেও এক সময় এসব দুর্যোগ মানুষ সহসাই মোকাবেলা করতো। নিজ বুদ্ধি-বিবেচনা, কৌশলের মাধ্যমে দুর্যোগ জয় করে ঘুরে দাঁড়াতো। কিন্তু বর্তমান চিত্রটা পাল্টে গেছে। স্থানীয় বাসিন্দারা এখন অনেকটাই অসহায়। বিশেষ করে সাধারণ মানুষ। ফি বছর দুর্ভোগ যেন তাদের ললাটে লেখা।
গেল তিন/চার মাস ব্যক্তিগত কাজে খুলনার উপকূলীয় এলাকায় একাধিক বার যাওয়ার সুযোগ হয়েছে। শুধু উপজেলা সদর বা যোগাযোগ সুবিধা সম্পন্ন এলাকায় নয়, প্রত্যন্ত এলাকায় ঘুরে বেড়িয়েছি। কখনো মোটরসাইকেলে, আবার কখনো পায়ে হেটে, ভ্যান বা নৌকা যোগে ঘুরেছি। এই ঘোরাঘুরি নতুন নয়, দীর্ঘদিনের পেশাগত জীবনে অত্যন্ত দুর্গম এলাকাও যাওয়ার সুযোগ হয়েছে। তবে এবারের কাজটি কিছুটা হলেও ব্যতিক্রম ছিল। টানা এতো দীর্ঘ সময়ে একটি বিষয় নিয়ে লেগে থাকা হয়নি। এ নিয়ে অদূর ভবিষ্যতে বিস্তারিত লেখার ইচ্ছে রয়েছে। আজকের আলোচনা আমার ভ্রমণ কাহিনী নয়। মানুষের দু:খ, দুর্দশা ও কষ্টের জীবনের।
ছেলেবেলার সময় খুব মনে পড়ে। কৈশোর, যৌবনের অনেকটা সময় কাটিয়েছি গ্রামে। আমাদের গ্রাম মানে তখন ছিল, দুর্গম এলাকা। এই এলাকা গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়া। তখন আমরা বিস্তীর্ণ জলাভূমির মানুষ। আশি-নব্বই দশকে রাস্তাঘাটের অস্তিত ছিল না। বর্ষা এলে ফি বছর বন্যা আমাদের গ্রাস করতো। পায়ে হাঁটা পথ আর নৌকা তখন আমাদের সম্বল। সেই এলাকার বর্তমান চিত্র এখন ভিন্ন। সেই গ্রাম্য ছেলেবেলায় ইচ্ছে হতো পাখি পোষার। চৈত্র-বৈশাখ মাস এলেই পাখির ছানার জন্য বনবাদারে ঘুরে বেড়াতাম। কোথায় পাখি বাসা করলো, কোথায় ডিম দিয়েছে বা পাখির ছানা বের হতো এ নিয়ে চলতো নিত্য গবেষণা। অভিভাবকদের চোখ ফাঁকি দিয়ে প্রতি বছরই জুটে যেত শালিক পাখির ছানা। এবার চলতো লালন-পালন, ছোট ছানার খাবার সংগ্রহের অভিযান। পাখির ছানার প্রিয় খাবার ‘ঘাস ফড়িং’। মাঠের পর মাঠ খুঁজে বেড়াতাম পাখির খাদ্য পোকামাকড়। অবশ্য ফড়িং শিকারের কাজটি খুব সহজ হতো না। এই এখানে দেখা গেল মুহূর্তে অন্য কোন স্থানে, অন্য কোনখানে। তারপরও ধরা পরতো সবুজের সাথে মিশে যাওয়া ফড়িং। মাঝে মাঝে মনে হতো ‘ফড়িং’র জীবন বড় বিচিত্র। যেন হাওয়ায় ভাসা, তাঁর স্থায়িত্ব নেই। নেই স্থায়ী ঠিকানা, জীবনের নিরাপত্তা!
চলতি বছরের ২৬ মে (২০২১) প্রবল ঘূর্ণিঝড় ‘ইয়াস’ আঘাত হানে উপকূলীয় এলাকায়। খুলনার উপকূলীয় এলাকা এ দূর্যোগের কেন্দ্র থাকলেও ঝড়ের প্রভাব পড়েনি। সংবাদের খোঁজে এদিন খুব সকালেই সহকর্মীদের সাথে পৌঁছে ছিলাম খুলনার কয়রা উপজেলায়। তখন দমকা হাওয়া বইছিল, ছিল বৃষ্টির ঝাপসা। আর কয়রার কপোতাক্ষ নদ, শাকবাড়িয়া নদী যেন রুদ্র রূপ ধারণ করেছে। প্রবল জোঁয়ার তখন বাঁধ উপচে পড়ছিল লোকালয়ে। হাজার হাজার মানুষের নির্ঘুম রাতের পর তখন যুদ্ধ চলছিল বাঁধ রক্ষায়। শুধু পুরুষই নয়, নারী-শিশু ও বয়স্ক মানুষের বেঁচে থাকার এ সংগ্রামের চিত্র কথার লিপিতে তুলে ধরা অসম্ভব। আমরা সংবাদকর্মীরা ছুটছি এক বাঁধ থেকে অন্যবাঁধে। কখনো কাটকাটা, কখনো শাকবাড়িয়া, গেতিরঘেরি। আবার কখনো দশালিয়া, পবনা বেড়িবাঁধে। হাজারো চেষ্টার পরও এই উপজেলার ২০টির মতো বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে যায়। প্লাবিত হয় বিস্তীর্ণ এলাকা, মানুষের আবাস, মাছের ঘের বিলীন হয়। পরের ২/৩ দিন চেষ্টায় আবারও মানুষ অধিকাংশ বাঁধ বেধে পানি প্রবেশ বন্ধ করে। তারপরও গাতিরঘেরিসহ একাধিক বাঁধ আটকানো সম্ভব হয়নি।

বাঁধে আশ্রয় নেয়া শেফালী দাশ – ছবি লেখক

বাঁধ ভাঙনের সপ্তাহ দুয়েক পরে (৬জুন, ২০২১) আবার যাই উপকূলে। আগের যাত্রায় যে সড়কে মোটরসাইকেলে ছুটে ছিলাম, এবার সেই সড়কের অনেকগুলোই বেহাল। বিশেষ করে গাতিরঘেরির হরিহরপুর, বিনাপানি গ্রামে ভিন্ন চিত্র। পায়ে হাঁটা ছাড়া আমাদের আর উপায় নেই। খুলনা শহর থেকে প্রায় ১২০ কিলোমিটার দূরের তপ্ত দুপুরে যখন গাতিরঘেরিতে পৌঁছাই, তখন সেখানকার মানুষ স্বেচ্ছাশ্রমে নিজেদের চলার পথ সংস্কারে ব্যস্ত। কেউ ধসে যাওয়া ঘরের মধ্যে থেকে খুঁজে ফিরছিলেন হারানো কোন গৃহস্থালি সামগ্রী। স্বপ্ন দেখছিলেন ঘুরে দাঁড়ানোর।
এভাবে ঘুরতে ঘুরতে পৌঁছে যাই হরিহরপুরের কেয়ারের বাঁধে। দেখা গেল, এই বাঁধটির কিছু অংশ অক্ষত রয়েছে। সেখানে আশ্রয় মিলিয়ে প্রায় অর্ধশত পরিবারের। সেখানে তপ্ত রোদে ছোট খুপড়ি ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে শুকনো চেহরায় কান্না জড়িত কণ্ঠে কথা বলছিলেন গৃহবধূ শেফালী দাশ (৫৫)। তিনি চার কন্যা সন্তানের মা গাতিরঘেরি এলাকার বাসিন্দা। শেফালী দাশ বলছিলেন, ‘চোখের সামনে সবকিছু ভেসে গেল। রান্না করার মতো হাড়ি-পাতিল, থালা-বাসন পর্যন্ত নেই। জলের তোড়ে ঘর ছাড়া সবকিছু ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। ঘরের আড়া (কাঠ বিশেষ) ধরে কোনভাবে জীবন নিয়ে বেঁচে আছি। ঘরে কবে ফিরতে পারবো জানিনা।’
শুধু শেফালী দাশ নয়, ১০ বিঘার জমির মালিক গাতিরঘেরির রবি গাইন (৫৫) সবকিছু হারিয়ে পাগল প্রায়। স্থানীয়রা বলছিলেন, মানুষটি একেবারে ভেঙ্গে পড়েছেন। স্থানীয়রা জানালো, তাঁর (রবি) স্ত্রীর অকাল প্রয়াণ হয়েছে। একটি মাত্র সন্তান। এখন ত্রাণ পেলে তাঁর খাবার জোটে, না হলে অভুক্ত থাকতে হয়। ভাঙনে তাঁর সব ভেসে গেছে। একজন, দুইজন নয়, মানুষের কত কষ্ট-আক্ষেপ বর্ণনা করা মুশকিল। বিনাপানি গ্রামের নিতাই কৃষ্ণ গাইন (৫৫) বলছিলেন, ‘বাঁধ বাঁচানোর জন্য এমন কোন চেষ্টা নাই করিনি। ২/৩ফুট জল বেড়েছে। গাতিরঘেরি ভেঙ্গে যায়। মর্হূতে ৫/৬টি গ্রাম ভেসে গেছে। ঘের, বাড়ি-ঘর, গাছ-গাছালি, পশুপাখি কিছুই রক্ষা করতে পারিনি।’
বলছিলাম উপকূলীয় এলাকায় আমার সাম্প্রতিক ঘোরাঘুরির কথা। উপকূলের কয়রা, দাকোপ, পাইকগাছায় যেখানেই গিয়েছি, সেখানেই নানা কথা মধ্যে উঠে এসেছে ‘বেড়িবাঁধ’ প্রসঙ্গ। সবার এক কথা টেকসই বাঁধ না হলে কিছুই হবে না। শোনা যায়, বাঁধ নিয়ে নানা অনিয়মের কথা। ফি বছর বাঁধ বাণিজ্যের কথা। হাজার হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ হলেও কেন প্রতিবছর বাঁধ ভাঙ্গে – তা নিয়ে আছে নানা কথা। স্থানীয়রা বলছিলেন, ষাট ও সত্তুরের দশকের পর আর উপকূলে বেড়িবাঁধ হয়নি। হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে যা হয়েছে, তা সবই রিং বাঁধ। এতো এতো বাঁধ নির্মাণ হলেও সংকট তো কাটেনি বরং দিন দিন বাড়ছে। ষাটের দশকে যে বাঁধের উচ্চতা ছিল সাড়ে ৭ ফুট। তা এখন ধীরে ধীরে কমছে। বাঁধ তলদেশে প্রস্ততা একশ মিটার থেকে এখন ৪০-৪৫ মিটারে এসেছে ঠেকেছে। বাঁধ ভাঙন ও সংস্কারের নামে পুরনো বাঁধকে কেটেকুটে ছোট করা হয়েছে। শুধু কী তাই, বাঁধের শত্রু চিংড়ি এখন গলার কাটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাঁধ ছিদ্র করে পাইপ ঢুকিয়ে লবণ পানি উত্তোলন, গৈ-ঘর (পানি উঠানামার জন্য সরু ড্রেন বিশেষ) নির্মাণ করা হয়। প্রতিবছর নদীর পানি বৃদ্ধি পায়, আর ছিদ্রযুক্ত স্থানে ভাঙন ধরে। এ তথ্য এখন প্রকাশ্য। বাঁধ ক্ষতির এই উৎসব আদালত, সরকার প্রধানের নির্দেশেও বন্ধ হয়নি। কষ্টের গল্পের দৈর্ঘ্য আরও বেশী। বলছিলাম বাঁধ বাণিজ্যের কথা। প্রতি বছর বাঁধ ভাঙ্গে, প্রকল্পের পর প্রকল্প হয়। দরপত্র হয়, ঠিকাদাররা কাজ পান. . . । এবার ওই কাজ বিক্রি হয়। জানাগেল, বাঁধ সংস্কারে দীর্ঘদিনের সিন্ডিকেট। তারাই ফি বছর বাঁধ সংস্কার করেন। কারা কাজ পেলেন সেই বিষয়টি এখানে গৌন। সরকারি নিয়ম থাকলেও কাজের বিবরণী, বরাদ্দ, ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের নাম দিয়ে প্রকাশ্যে সাইনবোর্ড সাঁটানো হয়না। স্থানীয়রা চান তাদের অংশগ্রহণ ও মতামতের ভিত্তিতে বাঁধ নির্মাণ তা আর হয়না; বাঁধ বাণিজ্য প্রকট হয়। এই বাঁধ নিয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো), জনপ্রতিনিধিদের বিরুদ্ধেও তীব্র ক্ষোভ সাধারণ মানুষের। তারা পাউবো ও জনপ্রতিনিধিদের সাথে এই বাঁধ সিন্ডিকেটের সম্পৃক্ততার অভিযোগ করেন। জরুরী প্রয়োজনে পাউবো’র অর্থ সংকটের বিষয়টিও দীর্ঘদিনের আলোচিত। কেউ কেউ বলছেন, জরুরী সময়ে ঠিকাদাররা কাজ করে দেড় থেকে দু’বছর লাগে বিল পেতে। তাই তারা (ঠিকাদার) দায়সারা কাজ করেন; যার দুর্ভোগের শিকার হন স্থানীয় বাসিন্দারা।
লেখার শুরুর দিকে ঘাসফড়িংয়ের জীবন নিয়ে স্মৃতিরোমন্থন করেছিলাম। সত্যিকার অর্থে এই উপকূলের মানুষের জীবনও সেই ‘ঘাসফড়িং’র মতো। কোন নিরাপত্তা নেই, ঘর-বাড়ি আবাসের স্থায়িত্ব নেই। আজ সুখের সংসার তো কাল বাঁধের খুপড়িতে জীবন। এ জীবন শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে বসে কল্পনা করা যাবেনা। তাঁদের কষ্টের অনুভূতি সেখানে হৃদয়ে আঁচর কাটবে না। প্রশ্ন উঠে লাখ লাখ মানুষের এই জীবন আর কতদিন বা কতকাল।
সত্যিই কী উপকূলে বাণিজ্যমুক্ত টেকসই বাঁধ হবে। উপকূলবাসী তাদের দীর্ঘ সংকটের স্থায়ী সমাধান পাবে। এখন দাবি উঠছে, স্থানীয় মানুষের মতামতের ভিত্তিতে বাণিজ্যমুক্ত টেকসই বাঁধের। সেই দাবি অত্যন্ত যুক্তিযুক্ত। আমরা আশাকরি গণমানুষের দাবি বাস্তবে আলোর মুখ দেখবে। উপকূলবাসী ‘ঘাস ফড়িং’র জীবন নয়, মানুষের জীবন ফিরে পাবে।
লেখক : নিজস্ব প্রতিবেদক, খুলনা; দৈনিক কালের কণ্ঠ